অগ্নিবীণা কাব্যের বিষয়বস্তু/ শিল্পমূল্য বিচার

অগ্নিবীণা কাব্যের শিল্পমূল্য বিচার অগ্নিবীণা কাব্য বৈশিষ্ট্য

অগ্নিবীণা কাব্য:এই সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলাম এক বিদ্রোহী সত্ত্বা। অগ্নিবীণা কাব্যে কবি বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে- সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করার আকুতিতে কবি উন্মাদপ্রায় ।

নজরুলের এই সংগ্রাম ও বিপ্লব আকাঙ্খাই আপোষ নেই, বিরাম নেই, ক্লান্তি নেই ।

অগ্নিবীণার বিদ্রোহ সর্বাত্ত্বক রাজার বিরুদ্ধে, আইনের বিরুদ্ধে, তথাকথিত নীতিবোধের বিরুদ্ধে এবং বিশ্ববিধাতার বিরুদ্ধেও বটে ।

সদ্য যুদ্ধক্ষেত্র ফেরত সৈনিকের হৃদয়াবেগ ও অভিজ্ঞতা অগ্নিবীণায় প্রকাশ পেয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে পৃথিবীর পরাধীন দেশ ও নিপীড়িত অনুন্নত মানুষের মধ্যে স্বাধীকার লাভের যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠেছিল নজরুল তারই স্বরূপ উপলব্ধি করেছিলেন ।

অগ্নিবীণা কাব্যের ভাব
অগ্নিবীণা কাব্যের কবিতাগুলোর সিংহভাগই উদ্দীপনামূলক কবিতা। ভেতরে শক্তি সঞ্চার করার জন্য যা দরকার তাই বর্ণনা করেছেন নজরুল। এই উদ্দীপনা তারুণ্য শক্তির আদর্শ, আত্মজাগরণ – সর্বোপরি যুব শক্তির জাগরণ।
উদ্দীপনা ভাবে রচিত কবিতা গুলো হলো- প্রলয় উল্লাস, বিদ্রোহী, রক্তাম্বরধারিণী মা, আগমনী, কামাল পাশা, আনোয়ার, রণভেরী, শাত-ইল-আরব, খেয়া পারের তরণী, কোরবানি এবং মহররম। অগ্নিবীণা কাব্যের কবিতা নিম্নোক্ত চারটি ভাবধারার অন্তর্গত করা চলে:

১) বিদ্রোহ ভাবের প্রকাশ থাকিলেও প্রধানত কবিচিত্তের উল্লাসের প্রকাশ মূলক কবিতা ’’বিদ্রোহী’’।

২)তদানীন্তন ভারতবাসীর চিত্তে জাগরণ সঞ্চারের অভিপ্রায়- রক্তাম্বরধারিণী মা, আগমনী, কামাল পাশা, আনোয়ার, রণভেরী, কোরবানি, মহররম, শাত-ইল-আরব ।

৩) নতুন জীবন ও নতুন সম্ভাবনার অভিব্যক্তি-’প্রলয় উল্লাস, ধুমকেতু ,

৪) ধর্মমূলক ভাবনার রুপায়ন -’খেয়া পারের তরণী’

কবি নজরুল জাতীয়তার প্রশ্নে বাঙালি, রাষ্ট্রতন্ত্রে ভারতবাসী, আর ধর্মের দিক থেকে মুসলিম। ফলে শব্দের নির্বাচনে কবি কখনো ভারতীয় পুরাণের ইমেজ, কখনো ইসলামের ঐতিহ্য, কখনো একান্তভাবে বাঙালির নিজস্ব শব্দাবলীকে আপন হিসেবে গ্রহণ করেছেন ।

তিনি সার্থকভাবে বিদেশি শব্দও ব্যবহার করেছেন।

তৎসম – তদ্ভব এবং আরবি ফারসি শব্দের শিল্পিত ব্যবহার সঙ্গতির সুষমায় কখনও কখনও নিয়ে এসেছে ব্যঞ্জনার বিদ্যুৎ দীপ্তি ।

’কান্ডারী এ তরীর পাকা মাঝি মাল্লা

দাড়ি মুখে সারি গান লা শরীক আল্লা ‘
-[খেয়া পারের তরণী]


অগ্নিবীণা কাব্যে ব্যবহৃত তৎসম তদ্ভব দেশী এবং বিদেশী শব্দের মধ্যে নেই কোন জাত বিচার। যেমন –

‘ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া

খোদার আসন আরশ ছেদিয়া……..

আমি মানি নাকো কোনো আইন

আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি আমি টর্পেডো আমি ভীম ভাসমান মাইন …….

আমি চল-চঞ্চল ঠুমকি’ ছমকি’

পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’ ……

আমি চির-দুরন্ত-দুর্ম্মদ আমি দুর্দ্দম

মম প্রাণের পেয়ালা হর্দম হ্যায় হর্দম ভরপুর মদ’

-[ বিদ্রোহী]

—————————————————————————————————-

উক্ত কবিতায় ব্যবহৃত ভেদিয়া, ছেদিয়া, ভীম, ভাসমান মাইন, ভরপুর মদ, দুরন্ত দুর্মদ ইত্যাদি দেশি-বিদেশি পৌরাণিক শব্দ বা বাক্যবন্ধ অবলীলায় ব্যবহৃত হয়েছে ।

অগ্নিবীণা কাব্ চিত্রকল্পের ব্যবহার –

পৌরাণিক অনুষঙ্গ এবং পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাস ঐতিহ্যের উপাদান আশ্রয়ে চিত্রকল্প রচনায় বিশেষ সার্থকতার পরিচয় রেখেছেন নজরুল ।

নজরুলের কবিতায় দৃশ্য রূপময় চিত্রকল্পের সংখ্যায় অধিক তবে পঞ্চ ইন্দ্রিয় নির্ভর চিত্রকল্প তার কবিতায় যথেষ্ট পাওয়া যায় ।

যেমন-

’দুশমন লোহু ঈশাই নীল

তব তরঙ্গ করে ঝিলমি

তব তরঙ্গ করে ঝিলমিল‘

-[শাত-ইল-আরব]


এখানে শত্রুর রক্তকে শাত-ইল-আরব নদীর উর্মিমালার ঝিলমিল চিত্রের মধ্যে কবি প্রত্যক্ষ করেছেন আবার,

‘ নাচে পাপ সিন্ধুতে তুঙ্গ তরঙ্গ

মৃত্যুর মহানিশা রুদ্র উলঙ্গ’

-[খেয়া পারের তরণী]


উপরোক্ত লাইনে চিত্রকল্পে কেয়ামতের ভয়াবহতা দৃশ্যময় করতে সাগরের উত্তাল উর্মিমালা এবং নটরাজ শিবের তান্ডব নৃত্যের মাঝে কবি নির্মাণ করেছেন সাদৃশ্য ।

‘ঝামর তাহার কেশের দোলায় ঝাপটা মেরে গগণ দুলায়
সর্বনাশী জ্বালামুখী ধূমকেতু তার চামর চুলায়’

-[প্রলয়উল্লাস]

উপরোক্ত লাইনে কবির মানুষ অভিপ্সা প্রকাশের বাহন হিসেবে নটরাজ শিবের চিত্রকল্প ব্যবহার হয়েছে।

অগ্নিবীণা কাব্যে ছন্দের ব্যবহার:

কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহের বাণী ঝংকার দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে এই কাব্যে ব্যবহার করেছেন মাত্রাবৃত্ত এবং স্বরবৃত্ত ছন্দ।যেমন ’বিদ্রোহী’ কবিতা 6 মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দ, ’রক্তাম্বরধারিণী মা’ 6 মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দ, ’আগমনী’ 6 মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দ, ’রণ-ভেরী’ 6 মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দ, ‘প্রলয় উল্লাস’ 4 মাত্রার স্বরবৃত্ত ছন্দ, ’কামাল পাশা’ 4 মাত্রার স্বরবৃত্ত ছন্দ ইত্যাদি।

মাত্রা বিন্যাস করলে দেখা যায় মাত্রাবৃত্ত ছন্দে বিদ্রোহী কবিতা তে এক অদ্ভুত প্রবাহমানতা এনেছেন নজরুল। এই কবিতাটি তে অসাধারণ নৈপুণ্যতা এবং সেইসঙ্গে অপূর্ণ ও অতিপর্বের এক অভূতপূর্ব বিন্যাস।


‘ আমি /সন্ন্যাসী সুর/-সৈনিক
‘আমি /যুবরাজ মম/ রাজবেশ ম্লান /গৈরিক

আমি /বেদুঈন ,আমি/ চেঙ্গিস

আমি/ আপনারে ছাড়া /করি না কাহারে/ কুর্ণিশ।’

-[বিদ্রোহী]

এখানে প্রথম পঙক্তি শেষে অপূর্ণ পর্ব আছে সৈনিক ভেঙে লিখলে হয় ( সই+নিক )।মাত্রাবৃত্ত ছন্দ অনুযায়ী ৪মাত্রা বিশিষ্ট।একইভাবে গৈরিক (গই+রিক) এর সঙ্গে আমি চেঙ্গিশ ( চেঙ+ ইস) এর সঙ্গে আমি কুর্ণিশ (কুর+নিশ) এর সঙ্গে ’আমি’ যোগ করলে 6 মাত্রা হয়- যা পূর্ণ পর্বের মাত্রা সংখ্যার সমান হয় ।

’প্রলয় উল্লাস কবিতায় দেখা যায় স্বরবৃত্ত ছন্দ ।যেমন –

আসছে এবার /অনাগত/ প্রলয় নেশার/ নিত্য পাগল

সিন্ধু-পারের/ সিংহদ্বারে/ ধমকে হেনে/ ভাঙলো আগল

মৃত্যু গহণ /অন্ধকূপে

মহাকালের/ চন্ড রূপে ।’

[‘প্রলয় উল্লাস’]

উক্ত চরণগুলো স্বরবৃত্তে ছন্দে চার মাত্রার বিন্যাস রীতির ব্যবহার হয়েছে।

অগ্নিবীণা কাব্যে অলংকার ব্যবহার-

অগ্নিবীণা কাব্যে শব্দ অলংকার এবং অর্থ অলংকার এর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এর মধ্যে আছে উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক, অতিশয়োক্তি অনুপ্রাস ইত্যাদি।

অগ্নিবীণা কাব্যে উপমা ব্যবহার-

‘ছুটি ঝড়ের মতন করতালি দিয়া

স্বর্গ মর্ত্য-করতল ‘
-[বিদ্রোহী কবিতা]

উল্লেখিত লাইনে উপমা ’ঝড়’, উপমেয় ’করতালি’, সাধারণ ধর্ম ’ছুটি’, সাদৃশ্য বাচক শব্দ ’মতন’, ইত্যাদির ব্যবহার হয়েছে।

অগ্নিবীণা কাব্যে রূপকের ব্যবহার-

নজরুলের কবিতায় পৌরাণিক চরিত্রের আগমন ঘটিয়ে সেসব চরিত্র দ্বারা রূপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন অনুষঙ্গকে। কোরবানী কবিতায় ত্যাগের প্রতীক হিসেবে রূপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে ইব্রাহিমের নাম ।

‘এও ইব্রাহিম আজ কোরবানি কর শ্রেষ্ঠ পুত্রধন

ওরে হত্যা নয় আজ সত্যাগ্রহ’ শক্তির উদবোধন’

-[কোরবানী]

অগ্নিবীণা কাব্যে অনুপ্রাস এর ব্যবহার-

অনুপ্রাস এর ব্যবহার নজরুল কাব্যের প্রথম পর্যায়ে অত্যন্ত প্রবল। অগ্নিবীণার কাব্যে শ্রত্যানুপ্রাস,অন্ত্যানুপ্রাস, বৃত্তানুপ্রাস ,ছেকানুপ্রাস সবকিছুর প্রভাব রয়েছে। যেমন-

’ আমি সর্বনাশের ঝাণ্ডা উড়ায়ে বোও বোও ঘুরি শূন্যে,
আমি ধূমবান হানি একা ঘিরে ভগবান অভিমুন্য

শোও শন-নন-নন-শন-নন- নন শাই-শাই

ঘুর পাক খাই, ধাই পাই পাই।’

  • [ধুমকেতু]

উপরোক্ত কবিতায়- অভিমুন্য, বোও বোও, শূন্যে,শন-নন-নন-শন- নন- নন,শাই-শাই,ঘুর পাক খাই, ধাই পাই পাই ইত্যাদি শব্দগুচ্ছ দারা বৃত্তানুপ্রাস, অন্ত্যানুপ্রাস, ছেকানুপ্রাস ইত্যাদি একইসাথে প্রকাশ পেয়েছে।

অগ্নিবীণা কাব্যে রসের ব্যবহার

অগ্নিবীণা কাব্যে প্রধানত বীররস, ভয়ানক রস ও করুণ রসের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় ।যেমন-

‘ বল বীর –

বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি আমারি নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রী ‘

-[বিদ্রোহী]

এখানে অন্যায়কারী শাসকের বিরুদ্ধে শোষিত মানুষের চিত্তে অন্যায়ের প্রতিরোধের উৎসাহ সঞ্চারিত হয়েছে। এটি বীররসের উজ্জ্বল উদাহরণ। এছাড়াও নজরুলের কাব্যে বিভিন্ন পৌরাণিক শব্দের ব্যবহার -ভীম ,শিব, নটরাজ ,চন্ডী, বিশ্বামিত্র, দুর্বাসা, দুর্গা, কৃষ্ণ, পরশুরাম ইত্যাদি ব্যাবহার হয়েছে।

অতএব এটি বলা যায় যে, গদ্য রঙে চলিত রীতির ব্যবহার, আরবি-ফারসি ,বাংলা, ইংরেজি ,তৎসম ,তদ্ভব শব্দের মিশ্র ব্যবহার এবং ধ্বনি মাত্রিক ছন্দের ব্যবহার অগ্নিবীণা কাব্যটিকে এক বিশিষ্ট মর্যাদায় সার্থকতা দান করেছে।

(অগ্নিবীণা কাব্য)

নজরুলের অগ্নিবীণা কাব্য সম্পর্কে-click here

আরো অন্যান্য বিষয়-click here

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *