বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম উপন্যাস প্যারীচাঁদ মিত্র রচিত ‘আলালের ঘরের দুলাল ‘।প্যারীচাঁদ মিত্রের জন্ম ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দের ২২ জুলাই কলকাতায় ।প্যারীচাঁদ মিত্রের মানস গঠিত হয়েছে রামমোহনের ব্যক্তিত্বের আলোকে, ইয়ংবেঙ্গলদের সঙ্গে, আর তার প্রতিভার স্ফূরণ ঘটেছে বিদ্যাসাগরের সমকালে ।
ডিরোজিওর ছাত্র হিসেবে বাংলা সাহিত্যে একমাত্র প্যারীচাঁদ মিত্র তার স্থায়ী আসন তৈরি করতে পেরেছে। সাহিত্য কর্মী হিসেবে প্যারীচাঁদের খ্যাতির উৎস তার অবিস্মরণীয় গ্রন্থ আলালের ঘরের দুলাল ।
এই উপন্যাসের কাহিনী নির্মাণের ক্ষেত্রে ফরাসি লাসাজের ‘জিল বা’ পিকারেস্ক উপন্যাসের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় ।
এই উপন্যাসে কিছু চরিত্রের মাধ্যমে ঊনবিংশ শতাব্দীর মানুষের সামাজিক রীতিনীতি ও জীবন ধর্মের বৈশিষ্ট্য গুলো বিশেষ ভাবে ফুটে উঠেছে ।
হাজার ১৯ শতকের বাংলায় হিন্দু মধ্যবিত্ত জাগরণের সঙ্গে সঙ্গে বৃত্ত এবং বিদ্যা যখন সমাজ শাসনের অধিকার গ্রহণ করল তখন স্বাভাবিকভাবেই শুধুমাত্র বৃত্তের অধিকারীরা উশৃংখলতার চক্রাবর্তে নিমজ্জিত হলেন ।তখন এই অবক্ষয় পরিণতি থেকে সমাজকে রক্ষা করবার জন্য ব্রাহ্মণ সমাজ রেখেছিল এক ঐতিহাসিক ভূমিকা ।প্যারীচাঁদ মিত্র এই নবলব্ধ দৃষ্টিকোণ থেকে লক্ষ্য করলেন ধর্ম ও নীতিহীনতাই এই উচ্ছৃংখলতার মূল কারণ ।আর এই দৃষ্টিকোণ থেকেই তিনি অংকন করলেন ’আলালের ঘরের দুলাল উপন্যাস’ ।
ছোটবেলা থেকেই অতি আদরে ধনী পুত্র মতিলাল কখনো ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা পায়নি অথচ অসৎ সঙ্গে সে অবনতির শেষ ধাপে এসে দাঁড়িয়েছে ।অন্যদিকে মতিলালের অনুজ রামলাল আদর্শ চরিত্র বরদা বাবুর একান্ত স্নেহছায়ায় বর্ধিত হয়ে তার সকল নির্দেশ মান্য করে সর্বজনের প্রশংসা অর্জন করেছে ।মতিলালের চৈতন্যদয় এবং আদর্শ জীবনের প্রতি আকর্ষণে গ্রন্থের সমাপ্তি হয়েছে ।
গ্রন্থের এই দুই প্রধান ঘটনা স্রোত বিচিত্র খণ্ড ক্ষুদ্র ঘটনায় প্রাভাবিত হয়েছে। মূল ঘটনা অপেক্ষা এই বিচিত্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনায় গ্রন্থটির আশ্চর্য সফলতার কারণ ।বস্তুত বরদা বাবুর মত মূর্তিমান নীতি পাঠ ,বেনি বাবুর মত সজ্জন অথবা আদর্শ যুবক রামলাল এরা কেউই উপন্যাসের মূল আকর্ষণ নয়। এদের মধ্যে সুশিক্ষা থাকতে পারে কিন্তু উপন্যাসের যা প্রধানতম উপকরণ -জীবনের স্পর্শ বাদ তা এই চরিত্রগুলোতে কোথাও নেই। ’আলালের ঘরের দুলালের’ অবিস্মরণীয় সাফল্য এনে দিয়েছে মতিলাল স্বয়ং এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গ হলঘর ,গদাধর ইত্যাদি ।
সাথে মুৎসুদ্দি বান্ছারাম, শিক্ষক বক্রেশ্বরবাবু ও সর্বোপরি একটি অপরূপ সৃষ্টি ঠকচাচা। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ সম্পর্কেই প্যারীচাঁদের তীক্ষ ও বাস্তব অভিজ্ঞতা ছিল এবং প্রত্যেকটি চরিত্রই সেই অভিজ্ঞতার আলোকে উদ্ভাসিত হয়েছে । এই চরিত্রগুলো পড়লেই বোঝা যায় উনবিংশ শতাব্দীর মানুষের জীবনযাপন ও আচার-আচরণ কেমন ছিল ।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের দিকে লক্ষ্য করলে চোখে পড়বে শুধু ধর্মীয় বা রোমান্টিক আখ্যান উপাখ্যান ।তৎকালে কবিগণ ধর্মের আশ্রয়ে তাদের রচিত সাহিত্য প্রসিদ্ধ করেছেন কিন্তু ঊনবিংশ শতকের সাহিত্য দৃষ্টিতে প্যারীচাঁদ নিয়ে এলেন বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা ,প্রথা ,সীমাবদ্ধতা ও দুর্নীতির জিগির।
সদ্য পরাধীন একটি দেশ ,সে দেশের সংস্কৃতি রীতিনীতিতে অবাধে চলছে দখলদারদের সংস্কৃতির মিশেল ।কোর্ট-কাচারি আইন-কানুন ঢেলে সাজানো হচ্ছে। বাঙালিরা এগুলোকে আশ্রয় করে নতুন নতুন পেশার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। ধুতি ছেড়ে প্যান্ট পরছে ,পাম্প সু ছেড়ে বুট ধরছে, ঠিক এরকম একটি সময়কে প্যারীচাঁদ বেছে নিয়েছিলেন উপন্যাস রচনার জন্য।
ইংরেজদের প্রশ্রয়ে জমিদার ,তহসিলদার, জোতদার শ্রেণীর উত্থান হচ্ছে আর কিছু শ্রেণি গড়ে ওঠেছে ইংরেজদের আদালতকে ঘিরে মুহুরী পেশকার উকিলের সহকারি প্রভৃতি কয়েকটি পেশা ।
এমনই একজন ছিলেন বাবু রাম বাবু ।তার বিপুল বৈষয়িকতার মধ্যে তিনি ভুলে যান তার একমাত্র পুত্রকে নৈতিকতার শিক্ষা দিতে ।পিতার এমন আদর ও ঔদাসীন্যে পুত্র মতিলাল বখে যায় ।
মতিলাল এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। তাকে কেন্দ্র করেই ঘটনা প্রবাহিত হতে থাকে ।
মতিলাল কে বিভিন্ন উপায়ে শিক্ষিত করতে ব্যর্থ হয়ে বাবা তার বিয়ের ব্যবস্থা করেন ।তাতেও মতির মতি ফেরে না।
বাবার মৃত্যুর পর পুরো বিষয়-আশয় করায়ত্ত করে মতিলালের ভোগ বিলাসিতা ও অসৎকর্মের মাত্রা আরও বেড়ে যায় ।
চারিদিকে অসৎ ও কুসঙ্গ নিয়ে মতিলাল পরিবেষ্টিত হতে থাকে সর্বদা ।তাঁর অযোগ্যতা ও শিক্ষা হীনতার কারণে ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে ধরা খায় এবং প্রচুর ঋণ হয়ে যায় ।বৈদ্যবাড়ির বাড়ি বিক্রি করে দেয়। তার মা বোন তাকে ত্যাগ করে ।এক পর্যায়ে মতিলালের কাশি গিয়ে মতি ফেরে। সেখানে মা ও বোনের সাথে মিল হয় ।সামাজিক সমস্যা কে প্রাধান্য দিয়ে মূলত লেখক এটি রচনা করেছিলেন ।তৎকালীন কলকাতার আর্থসামাজিক অবস্থা ও বিভিন্ন স্তরের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যাপারে জানা যায় এই উপন্যাসের মাধ্যমে ।
দেশে ফারসির চাল ও ইংরেজির প্রতি নব আগ্রহ দেখিয়ে লেখক প্রত্যক্ষভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছেন বাংলার প্রতি উদাসীনতাকে। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিতদের কদর ও চাকরিতে অগ্রাধিকারের বিষয়ে লেখকের ছিল যেন কিঞ্চিৎ ক্ষোভ ।আর দুর্নীতির বিষয়াদি তো উপন্যাসের একটি বড় আকর্ষণ। টাকার বিনিময়ে মিথ্যা সাক্ষ্য, মিথ্যা মামলা সত্যে পরিণত করন দিয়ে যেন চির পরিচিত সামাজিক সমস্যা গুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন লেখক।
উপন্যাসের চরিত্রগুলো বিশ্লেষণ করলেই সে সময়কার মানুষের স্বরূপ এর সন্ধান মেলে সহজেই ।
বাবু রাম বাবু যিনি ছিলেন মতিলালের বাবা ।দিবস রজনী শুধু অর্থের পেছনে ছুটেন। সন্তানকে অতি আদরে ও বৈভবে রেখে নীতিহীন করেছেন্ বাংলাদেশে এমন উঠতি ধনীরা খুব অপরিচিত নয় । এদিকে মতিলাল মাদকাশক্ত চরিত্রহীন ও নীতিহীন এক কিশোর ।অতি আদরে বাঁদর প্রবাদের যথার্থ প্রয়োগ মেলে তার মধ্যে।
মতিলালের মা ও বোনেরা সে যুগের অন্তঃপুরবাসিনীদের প্রতিনিধিত্ব করে। বোনদের সংলাপে সে কথা বোঝা যায় ।
বাবুরাম বাবুর শুভানুধ্যায়ী বেনীবাবু ও বেচারাম ।যাদের ওপর দায়িত্ব দেয়া হয় মতিলালের শিক্ষার। শেষে তারা ব্যর্থ হয় ।বাবুরামবাবু কে বেনীবাবু পুত্রের শাসনের ব্যাপারে উপদেশ দেয় তবুও বাবুরামবাবুকে নির্বিকার দেখায় ।আর আছে বাবুরাম বাবুর চারপাশে মোসাহেব দল ।এরা হা তে হা না তে না মেলায় সর্ব অবস্থায়।
ধনীদের চৌকাঠের তলায় পরজীবী হয়ে বাছাই এদের ধর্ম ।উপন্যাসের অপূর্ব চরিত্রটি হলো ঠকচাচা ।যার পরামর্শে ও সাহায্যে বাবুরাম বাবু মিথ্যা মামলা যেতে ফেরেন ।ঠকচাচার সাহায্যে লেখক তুলে ধরেছেন উপনিবেশিক যুগের প্রারম্ভিক সেই জোচ্চোর শ্রেণীকে যারা দুর্নীতি কে গ্রহণ করেছিল পেশা হিসেবে।’ আলালের ঘরের দুলাল’ কোন জটিল কাল বা বিশ্লেষণাত্মক উপন্যাস নয় ।
সরাসরি সুনীতি ও দুর্নীতির স্বরূপ তুলে ধরা হয়েছে এই উপন্যাসে ।লেখক নিজেও মাঝে মাঝে অনেক উপদেশ প্রদান করেছেন। আলালের ঘরের দুলাল বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক উপন্যাস না হলেও বাংলা সাহিত্যে প্রথম বাস্তববাদী মানুষের ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে বাঙালির জীবনের বিশেষ দিক গুলো ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে।
আলালের ঘরের দুলাল উপন্যাসের সম্পর্কে আরো জানতে Click here
To know other topics on Bangla literature. Click here