ভাষা বিজ্ঞান চর্চায় তুলনামূলক পদ্ধতি বিশ্লেষণ 

ভাষা বিজ্ঞান চর্চায় তুলনামূলক পদ্ধতি বিশ্লেষণ 
Categories:

তুলনামূলক পদ্ধতি: তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব এর ইংরেজি নাম Comperative linguistic.  এই ভাষাতত্ত্বে একাধিক ভাষার মধ্যে তুলনা করা হয় । অর্থাৎ একাধিক প্রাচীন ভাষার মধ্যে তুলনা করে তাদের সঠিক সম্পর্ক নির্ণয় করাই এই ভাষাবিজ্ঞানের কাজ ।

তুলনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের শব্দ ও বাক্যের আদিরূপ নির্ণয় করতে হলে বাংলা ভাষার সঙ্গে অসমীয়া ,উড়িয়া বাহিনীর প্রসঙ্গ যেমন আসতে পারে তেমনি ইংরেজি বা চীনা ভাষার প্রসঙ্গ আসতে পারে ।

এই ভাবে একাধিক ভাষার মধ্যে তুলনা করলে দেখা যায় তারা আলাদা ভাষাবংশ হলেও মূলত একই উৎস থেকে উদ্ভত হয়েছে ।১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি স্যার উইলিয়াম জোন্স এক বক্তব্যে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব প্রসঙ্গ আনেন ।মূলত এখান থেকেই তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের সূত্রপাত হয় ।

এই ভাষাতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ভাষাবিজ্ঞানীরা এর পটভূমি হিসেবে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন 

ক) নানাদেশে ইউরোপীয়দের ভৌগোলিক অভিযান 

খ ) তুর্কিদের কনস্টান্টিনোপল অধিকার 

গ) মুদ্রণযন্ত্রের প্রতিষ্ঠা 

ঘ ) মিশনারিদের ধর্ম প্রচার 

ক) নানা দেশে ইউরোপীয়দের ভৌগোলিক অভিযান :

১৯৪২ সালে কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের পর পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশের মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্র প্রসারিত হয় এবং একাধিক ভাষার সঙ্গে ইউরোপীয় পণ্ডিতদের সংযোগ স্থাপিত হয় ।আবার ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে ভাস্কোদাগামা 

ভারতের কালিকট বন্দরে উপস্থিত হন ফলে প্রাচ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্যের ভাস্কদাগামার আগমনের প্রভাব সুদূরপ্রসারী হয় ।

প্রকৃতপক্ষে এই নতুন পদ্ধতি আবিষ্কারের ফলে একদিকে যেমন পাশ্চাত্য প্রভাবে আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতিতে নবজাগরণ ঘটে অন্যদিকে ভারতীয় ভাষা সম্পর্কে ইউরোপীয়রা অবহিত হয় তখন তাদের তুলনামূলক ভাষা আন্দোলনে স্থান পায় সংস্কৃত ভাষা ।

খ )তুর্কিদের কনস্টান্টিনোপল অধিকার :

রোমানরা গ্রীস অধিকার করার পর কনস্টান্টিনোপল গ্রিক পণ্ডিতদের বিদ্যা কেন্দ্র হয়ে ওঠে ।তুর্কিরা যখন কনস্টান্টিনোপল দখল করে তখন সেখানকার গ্রিক ও রোমান পণ্ডিতরা ইতালিতে আশ্রয় নেয়। ফলে ইতালি গ্রিক সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসে ।

ইতালিরা ল্যাটিন শিল্প-সাহিত্য গ্রহণ করে ।এর ফলে পঞ্চদশ শতকে ইতালির নবজাগরণ দেখা যায় ।এইসময় গ্রীস ইতালির রোমের মানুষেরা পরস্পরের সঙ্গে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব চর্চায় আগ্রহী হয় ।

গ) মুদ্রণযন্ত্রের প্রতিষ্ঠা :

১৪৪৩ সালে জার্মানিতে প্রথম মুদ্রণ যন্ত্রের আবিষ্কার হয় ।পরে তা সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে বিভিন্ন দেশের ভাষার সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ হয় ।বিভিন্ন বই অনুবাদ এবং মুদ্রিত হবার ফলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যায়।

এতে বিভিন্ন ভাষার মানুষ তাদের ভাষার সাথে অন্য দেশের ভাষার তুলনামূলক চর্চার সুযোগ পাই 

তাহলে পাশ্চাত্য দেশে নবজাগরণের যুগে যে ভৌগোলিক অভিযান শুরু হলো এবং মুদ্রণ যন্ত্রের প্রচলন হলো তার ফলে বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পারস্পরিক যোগাযোগ স্থাপিত হয় ।

এতে এক ভাষার সঙ্গে অন্য ভাষার পার্থক্য সাদৃশ্য যতই ধরা পড়তে থাকে ততই ভাষাবিদদের মধ্যে তুলনা মূলক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠতে শুরু করে ।

ঘ) মিশনারীদের ধর্ম প্রচার :

১২০২-১২০৩ বাংলাদেশ তুর্কি আক্রমণের সময় মঠ- মন্দির ধ্বংস হয় । সেখানে ইসলাম ধর্মের প্রভাব দেখা যায় ধীরে ধীরে ।খ্রিস্টান মিশনারীরা একসময় ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাইবেলের অনুবাদ করে বিভিন্ন ভাষায় এবং তা পৌঁছে দেয় বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের কাছে ।এতে বিভিন্ন দেশের মানুষ শুধুমাত্র ধর্ম নয়, তুলনামূলক ভাষা চর্চায় আগ্রহী হয়ে ওঠে ।

স্যার উইলিয়াম জোন্স কলকাতার রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে বক্তৃতা দেন তাতেই লাতিন ,গথিক, কেল্টিক ,প্রাচীন পারস্যের আবেশীয় প্রভৃতি ভাষার সঙ্গে সংস্কৃতের সাদৃশ্যের সূত্রটি প্রথমে ধরিয়ে দিয়েছিলেন ।

তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব প্রাচীন নাম ছিল সাংস্কৃতিক ভাষাতত্ত্ব। ভারতের মাটিতে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব চর্চার সূত্রপাত হলেও এই ধারার বিকাশ হয়েছিল জার্মানিতে ।জার্মান পন্ডিত শ্লেগেল এ ব্যাপারে ভূমিকা নেন। তিনি পৃথিবীর ভাষাগুলোকে তুলনা করে তার উৎস ইতিহাস ও ক্রমবিকাশের ধারা আলোচনা করেন ।

On the language and wishdom of the Indians গ্রন্থে,তিনি তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব এর মূল নীতি প্রয়োগ করেন ।

এখানে বিভিন্ন ভাষার অভ্যন্তরীণ গঠন এর তুলনা করে তাদের বংশগত অভিন্ন উৎসের নির্দেশ দিয়েছেন ।

শ্লেগেল এর হাত ধরেই আনুষ্ঠানিকভাবে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের আলোচনা শুরু হয় ।

তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব এর বৈশিষ্ট্য :

ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান এর মত ভাষার শব্দ ধ্বনি এর উৎস ইতিহাস ও ক্রমবিকাশের রোগ নির্ণয় করা হয় ।এ কারণে ভাষাবিজ্ঞানীরা একে ঐতিহাসিক ও তুলনামূলক ভাষাবিজ্ঞান বলেছেন ।

) একাধিক ভাষাকে উপাদান বা উপকরণ হিসেবে গ্রহণ করতে হয় তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে।

গ )তুলনামূলক পদ্ধতিতে কোন ভাষার শুধুমাত্র ভাষাগত দিক আলোচিত হয়। এখানেই তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান এর পার্থক্য ।

তুলনামূলক ভাষা পদ্ধতির প্রয়োগ :
  • রূপগত বৈপরীত্য :সবার আগে দেখতে হবে ভাষার তুলনা 
  • বিন্যাস গত সাদৃশ্য : এখানে বাক্যের গঠন অপরিহার্য 

যেমন :আমি- ভাত- খাই 

কর্তা- কর্ম- ক্রিয়া 

এখানে দুটি ভাষা একই গোত্রের হলেও ভাষার বিন্যাস এক থাকবে ।

  • সমতা : দুটি ভাষার ক্রিয়া শব্দ এবং অর্থের মিল থাকতে হবে। যেমন: হসপিটাল- হাসপাতাল 

তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব টি ব্যবহার করে ভাষাবিজ্ঞানীরা দুইটি কাজ করেছেন।

এক) ভাষার আদি রূপ নির্ণয় করেছেন ।

দুই) ধ্বনি পরিবর্তনের বিভিন্ন নিয়ম বের করেছেন।

সহায়ক গ্রন্থাবলী:

ভাষার ইতিবৃত্ত- সুকুমার সেন 

বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত -মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ 

সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলা – ভাষা রামেশ্বর শ 

ভাষাতত্ত্ব- রফিকুল ইসলাম 

তুলনামূলক পদ্ধতি বিষয়ক অন্যান্য- click here

তুলনামূলক পদ্ধতি ছাড়া অন্যান্য বিষয়- click here

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *