ফররুখ আহমদ মুসলিম রেনেসাঁস বা পুনর্জাগরণের কবি

ফররুখ আহমদ মুসলিম রেনেসাঁস বা পুনর্জাগরণের কবি

ফররুখ আহমদ মুসলিম রেনেসাঁস বা পুনর্জাগরণের কবি। বাংলা সাহিত্যে অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা কবি ফররুখ আহমদ (১৯১৮-১৯৭৪) যে সময় সাহিত্যচর্চা করেছেন সে সময়টা ছিল দুর্বল – অসহায় অতি সাধারণ মানুষের জন্য চরম সংকটকাল। বিশ্বে দু দুটি বড় বড় যুদ্ধ ;দেশে খাদ্য সংকট ,দুর্ভিক্ষ বেনিয়াদের অত্যাচার ,দেশীয় দালালদের দৌরাত্তা ও দাসত্ব,রাজনীতিতে দ্বিজাতি তত্ত্ব এবং এসব গোষ্ঠীর আত্মপ্রতিষ্ঠা ইত্যাদি  সমাজবিধ্বংসী চেতনা সমাজকে ঘোর অন্ধকারে টেনে এনেছিল। তখন ভারতবর্ষের মসনদে  বসে ইংরেজরা বৈষম্যের ডালা সাজিয়ে প্রজাকে করে রেখেছিল কোনঠাসা। মুসলমানদের ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনা এবং সহজ সরল সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে কবি ফররুখ আহমদ লিখতে শুরু করলেন একের পর এক কবিতা


আমরা জানি 1942 সালে পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটির অন্যতম সদস্য ছিলেন কবি ফররুখ আহমদ ।মুসলমানদের পুনর্জাগরণের ক্ষেত্রে ফররুখ আহমদ এর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ হল সাত সাগরের মাঝি ।

ফররুখের প্রেরণার উৎস কাজী নজরুল ইসলাম।

সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায় বলেছেন-

” সাত সাগরের মাঝি কাব্যের অধিকাংশ কবিতায় কবির ঐতিহ্যপ্রীতি ও ইসলামী ধর্মাদর্শের অকুণ্ঠ বিশ্বাস ও অনুরাগের পরিচয়ে পরিস্ফুট।”

সাত সাগরের মাঝি কাব্যগ্রন্থটি কবি ফররুখ আহমদ উৎসর্গ করেছেন কবি আল্লামা ইকবাল কে ।সাত সাগরের মাঝি কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে জাইনুল আবেদিন লিখেছেন –

”তরুণ কবি ফররুখ আহমদের সাত সাগরের মাঝি

তার জীবনের প্রথম প্রসূন, শুধু ভালো ভাবো ও ভাষাতেই যে তা নতুন এমন নয়,

দৃষ্টি এবং শিল্পনৈপুন্যেও তা নতুনত্বের ‍দাবি জানায়।”

উক্ত কাব্যগ্রন্থের পাঞ্জেরী কবিতাটি দেখি মুসলমানদের মজলুমের বেদনা ও মৃত্যুর জয়ভেরী-
”ওকি দরিয়ার গর্জন,- ও কি বেদনা মজলুমের

ওকি ক্ষুধাতুর পাঁজরায় বাজে মৃত্যুর জয়ভেরী

পাঞ্জেরী !”

—( কবিতা: পাঞ্জেরী )

সিন্দাবাদ কবিতায় কবি স্মরণ করলেন জাতির সোনালী অতীত কে ।

কেটেছে রঙিন মখমল ‍দিন, নতুন সফর আজ,

শুনছি আবার নোনা দরিয়ার ডাক,

ভাসে জোরওয়ার মাউজের শিরে সফেদ চাঁদির তাজ,

পাহাড় – বুলন্দ ঢেউ বয়ে আনে নোনা দরিয়ার ডাক;

—(কবিতা: ‍সিন্দাবাদ)

ফররুখ আহমদ লক্ষ্য করেছেন ইউরোপীয় পুনর্জাগরণ বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজ করেছে ঠিকই কিন্তু মানব আত্বার মুক্তি নিশ্চিত করতে পারেনি।

সেজন্য ঘটেছিল ১৭৫৭ সালে পলাশীর ঘটনা; ১৮৫৮ সালে আজাদী আন্দোলন; ১৯২৩ সালে তুরস্ক খেলাফতের অবসান সহ ইতিহাসের নানান ঘটনা। এমন সব ঘটনা ফররুখ আহমদকে প্রভাবিত করেছিল দারুণভাবে ।মুসলমানদের মুক্তির জন্য ফররুখ আহমদের প্রেরণার প্রধান উৎস ছিল নবুয়তের জ্ঞান আর দ্বিতীয় উৎস ছিল বাগদাদ কায়রো ও কর্ভোডার ইতিহাস । কিন্তু দুনিয়ার মানুষ শোষিত হচ্ছে পেত্রার্কী শোষণে।

ইতিহাস সচেতন কবি তাই তার লাশ কবিতায় লিখেছেন-

”যেখানে প্রশস্ত পথ ঘুরে গেল মোড় ,

কালো পিচ ঢালা রঙে লাগে নাই ধূলির আঁচড়

সেখানে পথের পাশে মুগ গুজে প’ড়ে আছে জমিনের ’পর

সন্ধ্যার জনতা জানি কোনদিন রাখে না সে মৃতের খবর।”

-( কবিতা: লাশ )

কবি নিজের সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে পুজিপতিদের শাসন শোষণের বিপক্ষে কথা বলেছেন। তিনি নিজের অনুভবের মাধ্যমে বুঝতে পেরেছেন জনসভ্যতার ভন্ডামি। এবং বিশ্ব শান্তি ও মানবিক ঐদার্যের জন্য স্ফীতমেদ শোষক শ্রেণীর প্রতি তীব্র ঘৃণা, ধিক্কার জানিয়েছেন। কবে চেয়েছেন শাসন শোষণের নিষ্ঠুর সভ্যতাকে ধ্বংস করে মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে। তাই তিনি লাশ কবিতায় আবারও বলেছেন-


”তোমার শৃংখল গত মাংসপিণ্ডে পদাঘাত হানি

নিয়ে যাব জাহান্নাম দ্বারপ্রান্তে টানি;
আজ এই উৎপীড়িত মৃত্যুদীর্ণ নিখিলের অভিশাপ বও

ধ্বংস হও

তুমি ধ্বংস হও।”

-( কবিতা: লাশ )



”রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?
এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে ?

সেতারা হেলাল এখনো ওঠেনি জেগে ?

তুমি মাস্তুলে আমি দাঁড় টানি ভুলে ;

অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরি।”

-( কবিতা:পাঞ্জেরি )

অত্যাচারীদের অত্যাচারে চারিদিকে চলছে মৃত্যুর মিছিল। পিতার কাঁধে উঠছে সন্তানের লাশ। কবিতায় কবি দুঃখ করে বলেছেন-

”সোহরাবের লাশ নিয়ে জেগে আছে নিঃসঙ্গ রুস্ত ”

কবি দেখতে পাচ্ছেন কৃষকের দুর্ভিক্ষ, অপমান ,লাঞ্ছনা এবং পেটের দায়ে নারীর বেশ্যাবৃত্তি ।

”আমি দেখি কৃষাণের ‍দুয়ারে দুর্ভিক্ষ বিভীষিকা,

আমি দেখি লাঞ্ছীতের ললাটে জ্বলিছে শুধু অপমান টিকা

গর্বিতের পরিহাসে মানুষ হয়েছে দাস

নারী হলো লন্ঠিতা নন্দিতা গণিকা”

—( কবিতা: আউলাদ )

কবি ফররুখ আহমদ এই ভঙ্গুর জাতিকে আবার জেগে ওঠার আহ্বান করেছেন। মুসলিম ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে পুনরায় সবাইকে সংগ্রাম করতে বলেছেন কবি ফররুখ আহমদ।

”ভেঙে ফেলো আজ খাকের মমতা আকাশে উঠেছে চাঁদ

দরিয়ার বুকে দামাল জোয়ার ভাঙছে বালুর বাধ,

ছিড়ে ফেলে আজ আয়েশী রাতের মখমল অবসাদ,

নতুন পানিতে হাল করে দাও ,হে মাঝি সিন্দাবাদ।”

— ( কবিতা: সিন্দাবাদ )

মুসলমানদের ও সুদিন এসেছিল কিন্তু আমরা সাড়া দেই নাই তাই কবি বলেছেন-

” দুয়ারে তোমার সাত সাগরের জোয়ার এনেছে ফেনা,

তবু জাগলে না? তবু তুমি জাগলে না?

সাত সাগরের মাঝি চেয়ে দেখো দুয়ারে ডাকে জাহাজ।”

— ( কবিতা:সাত সাগরের মাঝি )

নদীতে নৌকা ভাসানোর মত সামনের দিকে এগিয়ে যাবার অনুপ্রেরণা দিয়ে কবি বলেছেন

”তবে পাল খোলো তবে নোঙ্গর তোল

এবার অনেক পথ শেষে সন্ধানী

হেরার তোরণ মিলবে সম্মুখে জানি ।”

— ( কবিতা:সাত সাগরের মাঝি )

ফররুখ আহমদ সম্পর্কে আরো জানতে ক্লিক করুন এখানে-

অন্যান্য বিষয় জানতে ক্লিক করুন এখানে





Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *