বিদ্রোহী কৈবর্ত উপন্যাসের বিষয়বস্তু/ শিল্পমূল্য

গত শতকের ষাটের দশকে ইতিহাসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী ব্যাখ্যাকে আত্মস্থ করে এবং সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার শিল্পরীতি অবলম্বন করে, বাংলা ভাষায় যিনি ঐতিহাসিক উপন্যাস সৃষ্টিতে সাফল্যের দিগন্ত ছুঁয়ে গিয়েছিলেন তিনি সত্যেন সেন (1907-1981) ,এ পথে তিনি হাওয়ার্ড ফাস্ট ,তলস্তয় ও রাহুল সাংকৃত্যায়নের সুযোগ্য সহযাত্রী ।

সত্যেন সেন জীবন চেতনায় এবং শিল্প প্রকরণে ছিলেন মার্কসবাদী নন্দনতত্ত্বের অনুসারী । বিদ্রোহী কৈবর্ত (1969) 

সত্যেন সেনের একটি প্রতিনিধিত্বশীল উপন্যাস । শিল্পের জন্য শিল্প এই তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন না সত্যেন সেন ।সাহিত্য-শিল্প আদর্শে তিনি ছিলেন উদ্দেশ্য বাদী ।পরিণত বয়সে তিনি কেন উপন্যাস লিখতে শুরু করলেন, অজয় রায়ের এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি লিখেন-

”মানুষের কাছে যে কথা বলতে চাই সে কথা অন্যভাবে বলতে পারব না সেজন্য তাছাড়া অভিজ্ঞতা দিয়ে তো দেখলাম শ্রমিক কৃষক আন্দোলন করার উপযুক্ত নই আমি “।

বিষয়বস্তু :

এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু হিসেবে উপন্যাসিক গ্রহণ করেছেন পাল বংশের রাজা দ্বিতীয় ধর্মপালের রাজত্বকালের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কৈবর্ত বিদ্রোহ ও তাদের দ্বারা গৌড় রাজধানী দখলকে কেন্দ্র করে।

কাহিনী:

বিদ্রোহী কৈবর্ত উপন্যাসের কাহিনী অনুসারে গৌড়ের পাল রাজা দ্বিতীয় মহিপাল এর সময়ে বরেন্দ্র অঞ্চলের কৈবর্তদের ওপর নির্যাতন বেড়ে যায়। এ ব্যাপারে কৈবর্তরা বারবার কেন্দ্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করা সত্ত্বেও রাজারা কথা আমলে নেয়নি। 

ফলে শ্রেণী-সংগ্রামের সূত্র অনুসারে শ্রেণীহীন শোষিত শ্রেনী একত্রিত হয়ে আক্রমণ করে বসে গৌড়ের রাজধানী এবং শাসক রাজা দ্বিতীয় মহিপালকে উৎখাত করে শ্রেনীহীন কৈবর্তরা সৃষ্টি করে নতুন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ।

শিল্পরূপ :

উপন্যাসের শিল্পরূপ গণবিচ্ছিন্ন বিষয় নয় উপন্যাসের কাহিনী বিন্যাস ভাষা চরিত্রায়ন দৃষ্টিকোণ কল্পনা ইত্যাদি উপন্যাসিকের জীবনবোধের অনুগামী হলেই কেবল একটি উপন্যাস সার্থক শিল্প হয়ে ওঠে ।

উপকাহিনী :

বিদ্রোহী কৈবর্ত উপন্যাসের মূল কাহিনীর পাশাপাশি রয়েছে বেশকিছু উপকাহিনী উপকাহিনী ।

যেমন-

১. উনছলি ও ‍দিব্বকের গার্হস্থ্য জীবন ।

২.প্ররভু ও বল্লুকির বিবাহ আয়োজন ।

৩.রাজবৈদ্য হরিগুপ্ত ও শঙ্খদেবীর প্রেম

৪. কৈবর্ত সৃষ্টির উপকাহিনি ইত্যাদি।

৫. রাজা মহীপালের বিরুদ্ধে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র  ইত্যাদি।

অধিকাংশ উপকাহিনী যে পরিচ্ছেদে শুরু হয়েছে সে পরিচ্ছেদেই শেষ হয়েছে । মূল কাহিনীতে উজ্জ্বলতা ,স্পষ্টতা দেয়ার জন্য এবং পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখার জন্য উপন্যাসিক এগুলো সৃষ্টি করেছেন। এসব উপকাহিনী অধিকাংশই ঐতিহাসিক উপন্যাসের কাহিনী ।

রাজবৈদ্য হরি গুপ্ত এবং রাজমাতা শঙ্খ দেবীর প্রণয় সম্পর্কটি ইতিহাস সমর্থিত নয় । সত্যেন সেন ইতিহাসের কাঠামোর মধ্যে রাজপ্রাসাদের মধ্যে হরি গুপ্ত এবং শঙ্খ দেবীর মধ্যকার মানবিক সম্পর্ককে সম্ভবপর করে তুলেছেন ।তবে একথা স্বীকার্য যে হরিগুপ্ত শঙ্খদেবীর এই প্রধান উপ কাহিনীটি জীবন রসে সমৃদ্ধ হলেও উপ কাহিনীটির অতি প্রলম্বিত উপন্যাসের মূল কাহিনীর ক্ষতি এবং একাগ্রতা কে খুন করেছে। 

এই উপ কাহিনীটি অন্যান্য উপ কাহিনীর মত উপন্যাসের ধার না বাড়িয়ে ভার বাড়িয়ে তুলেছে ।

সমালোচকের মতে –

“কৈবর্ত বিদ্রোহ এই উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য হওয়া সত্ত্বেও সত্যেন সেন মানুষের ব্যক্তিজীবনের একাধিক মাত্রাকে ব্যবহার করেছেন যা উপন্যাসের কাহিনী কাঠামোর সঙ্গে অনিবার্য সূত্রে গ্রহীত নয় । তাদের পৌড় প্রণয় উপন্যাসের বাহুল্য সংযোজন বলেই মনে হয় “

-(রফিক উল্লাহ খান- সত্যেন সেনের উপন্যাস :বিষয় স্বাতন্ত্র্য ও শিল্পচেতনা )

ইতিহাস:

বিদ্রোহী কৈবর্ত উপন্যাসের মূল ঘটনা এবং অধিকাংশ চরিত্রই ঐতিহাসিক। যেমন উপন্যাসের পাল রাজবংশের চরিত্রগুলো ইতিহাস সমর্থিত ।

দ্বিতীয় মহিপাল ,বরাহস্বামি, মথনদেব, শঙ্খদেবী, রামপাল ,শুরপাল এরা সবাই ঐতিহাসিক চরিত্র। 

অন্যদিকে বরেন্দ্রীর কৈবর্ত সামন্ত দিব্বক ও তার ভাই রুদোক এবং তার সন্তান ভীম ও ইতিহাস সমর্থিত ।

কৈবর্ত ও মহিপাল এর নিহত হবার ঘটনা ইতিহাসে আছে কিন্তু প্ররভু ও বল্লুকির প্রেম ও বিবাহ উদ্যোগ ; হরি শঙ্খ প্রনয়, দিব্বক-উনছলির গার্হস্থ্য জীবন; ভাদু ,চাপাই মোড়ল, এগুলো ঔপন্যাসিকের নিজস্ব সৃষ্টি। ইতিহাসে বর্ণিত আছে যে, দিব্বক রাজা মহীপালের দুর্বলতার সুযোগে বরেন্দ্রী কে স্বাধীন বলে ঘোষণা করেন ।

কিন্তু উপন্যাসে উপন্যাসিক দেখিয়েছেন দিব্বক খোদ গৌড়ের সিংহাসন আরোহন করেন ।এখানে ইতিহাস এর ব্যত্যয় লক্ষ্য করা যায় কিন্তু স্মরণ রাখা দরকার উপন্যাসিক যখন কোন ইতিহাস থেকে কাহিনী কাঠামো গ্রহণ করেন তখন তিনি ওই ঐতিহাসিক কাহিনী কাঠামোর মধ্যে নিশ্চয় কোনো সম্ভাবনার ইঙ্গিত কে দেখেই গ্রহণ করেন। প্রকৃত ঔপন্যাসিকের ঐতিহাসিক রসের প্রতি যতোটা ঝোঁক থাকে সত্যের প্রতি ততটা নয় ।

বিদ্রোহী কৈবর্ত উপন্যাসে সত্যেন সেনের অন্যান্য উপন্যাসের মতোই সংলাপের প্রাচুর্য লক্ষ্য করা যায় ।

উপন্যাসিক যদিও এখানে সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণের প্রয়োগ করেছেন তবুও উপন্যাসে উপন্যাসিকের বিবরণ কম, চরিত্রের সংলাপ এর মধ্যে বর্ণনাত্মক পরিচর্যার বহুল প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। এই উপন্যাসটি মূলত সামষ্টিক চেতনার উপন্যাস । ফলে ব্যক্তি যখন সংলাপ বলে তখন সে সমষ্টির কথায় বলে ।

উপন্যাসে সংলাপের ভাষা এবং বর্ণনার ভাষা অভিন্ন হয়ে উঠেছে ।

এছাড়া উপন্যাসিক নিজে যেখানে বর্ণনা দিয়েছেন তখন চরিত্রের প্রতি এত নিকটবর্তী হয়ে বর্ণনা দিয়েছেন যে সে বর্ণনার ভাষাও যেন চরিত্রের ব্যক্তিগত সংলাপ বা স্বগোতক্তি হয়ে উঠেছে ।

চরিত্রের অন্তরঙ্গ হয়ে বর্ণনা দেবার একটা দৃষ্টান্ত :

”হ্যাঁ পাবে , তারা নিশ্চয়ই পাবে। সারা জীবন ধরে যে তারা দেখে এসেছেন সে স্বপ্ন একদিন সার্থক হয়ে উঠবেই ।ভাগ্যের নিষ্ঠুর বিধানে এতোকাল যারা পদদলিত হয়ে এসেছে, বর্বর বলে সকলের কাছে অবজ্ঞা ও ঘৃণার পাত্র বলে গণ্য হয়েছে একদিন তারাও মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে ”

উপন্যাসিক দীব্বকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কৈবর্ত জনগোষ্ঠীর অবস্থা তুলে ধরেছেন। এখানে বোঝা যায় যে উপন্যাসিকের অবস্থান চরিত্রের অতি নিকটে । সত্যেন সেন উপন্যাসের চরিত্রগুলো কে মানবিক ও জীবন্ত করে তুলেছেন। এক চরিত্রের মধ্যে বহু চরিত্রের ,এক মানুষের মধ্যে বহু মানুষের এবং এক স্বরের মধ্যে বহু স্বরের আভাস পাওয়া যায় ্

উপন্যাসিক যখন দীব্বকের এবং তার স্ত্রী অঞ্জলির অন্তরঙ্গ গার্হস্থ্য জীবনের দৃশ্য অংকন করেন তখন তাদের আলাপচারিতায় সমষ্টির সংকট সম্ভাবনার কথা চলে আসে । এভাবে চরিত্রের ক্রমবিকাশকে ওপন্যাসিক কৈবর্ত সমাজের চাহিদার সঙ্গে একই সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন ।

এই উপন্যাসের চরিত্র সমাজ বিকাশের, সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত । এভাবে কৈবর্ত সমাজের প্রয়োজনের ক্ষমতা অসীম বীরত্ব নিয়ে দেখা দিয়েছে ভাদু চরিত্রটি । এর কদিন বাদে বাহাদুর নিরুদ্দেশ কোথায় গেছে বুঝতে কারুরই বাকি রইল না ।

ভাদুর কাঁচা বয়সের বউটা কান্নাকাটি করতে লাগল আর সব মেয়েরা তাকে ধমক দিল-

” থাম চুরি আর কাঁদতে হবে না তোকে তোর ভাগ্য ভালো যে এমন সোয়ামি পেয়েছিস সেতো আমাদের জন্য ওদের সাথে যুদ্ধ করতে গেছে “

শুধু ভাদু নয়, উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র পরভু, যিনি এক মহানায়ক । তার বিবর্তন এবং পরিবর্তনের সঙ্গে ও সমাজ গতির রয়েছে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক সত্যেন সেন এভাবেই প্রতিটি চরিত্রের উদ্ভব বিকাশ বিবর্তন পরিণতিকে দেখিয়েছেন ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *