বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসের জগতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক অনন্য নাম। রবীন্দ্রনাথ প্রথমে উপন্যাসের নামকরণ করেছিলেন তিন পুরুষ কিন্তু এক পুরুষের অস্তিত্ব না থাকায় উপন্যাসটির নামকরণ করেছেন যোগাযোগ । যোগাযোগ উপন্যাস :
যোগাযোগ উপন্যাসের চ্যাটার্জি আর ঘোষাল পরিবার দুটোকে উপযুক্ত শ্রেণীর প্রতিভূ হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে ।বিপ্রদাস ক্ষয়িষ্ণু সামন্ত সমাজের বিশেষ প্রতিনিধি আর মধুসূদন উঠতি বাজার নির্ভর ধনবাদী সমাজের প্রতিভু ।
বিপ্রদাস শত শত বৎসরের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে উত্তরাধিকার হিসেবে লাভ করেছে ।তার দেহে- মনে আচার-আচরণে সত্যনিষ্ঠায় সে সমৃদ্ধির ফুটে ওঠে তা যেন উত্তরাধিকারসূত্রে লব্ধ ।মধুসূদন কঠোর কঠিন পরিশ্রমের পথ ধরে ধন আহরণ করেছে ।অর্থের প্রাচুর্যই তার গৌরব ।হাজার বছর লালিত সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য তার নেই ।
কাঁচা পয়সা যা একান্তই বাইরের জিনিস তার অভাব নেই। কিন্তু অন্তরের সংস্কৃতির দিক থেকে সে একান্তভাবেই দেউলে দিনহীন আভাজন। বিপ্রদাসের অনুজা কুমুদিনী সামন্ত সমাজের সুসমৃদ্ধ মানষ ঐশ্বর্য্যের মহিমা লালিত যেন। মধুসূদন তাকে পণ্য মূল্যে কিনে নিতে চাই। ধন-ঐশ্বর্য দিয়ে বাঁধতে চাই কিন্তু বারে বারে ব্যর্থ হয় ।
কুমুদিনীর মনের গহীনে যে সুধা আছে মধুসূদন তার নাগাল পায় না ।অন্তর মিশালে অন্তরের যে পরিচয় সহজ হয়ে উঠতে পারে মধুসূদন তা জানে না ।আর জানে না বলেই অপরকে সে পিড়িত করে, নিজেও পিড়িত হয়। সামন্ত সমাজের যে ্সমৃদ্ধি মানষ শ্রী তা ধনবাদী সমাজের জন্য নয়। তাকে লাভ করবে এই ধনতান্ত্রিক সমাজের সন্তান ।উপন্যাসিক যেন ইঙ্গিতে এ কথাটাই বলতে চান।
কুমুদিনী মধুসূদনের সংসারে প্রবেশ করেছে অবিনাশ ঘোষালের জন্মকে সম্ভব করে তোলার জন্যই ।উপন্যাসটিতে সামন্ত সমাজের অসঙ্গতি রূপেই যে ধনতান্ত্রিক সমাজ বিরাজ করছে; উপন্যাসিক রবীন্দ্রনাথ যেন বলতে চান যে সামন্ত থেকে ধনবাদী সমাজের প্রতিষ্ঠা উত্তরণ নয় ,এটা কেবলমাত্র সামন্ত সমাজের অসঙ্গতিতেই। কুমুদিনী আর মধুসূদনের সন্তান সম্ভাবনার মধ্য দিয়েই এই অসঙ্গতির নিরাকরণ সম্ভব ।
রবীন্দ্রনাথ তাই নিশ্চিত জানেন যে সামন্ত সমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এবং যাবে কিন্তু ধনতান্ত্রিক সমাজ তার যোগ্য উত্তরাধিকার নয়। উপন্যাসিক জানেন সামন্ত সমাজ তার ঐশ্বর্য হারিয়ে নিঃশ্বাসে বিলুপ্ত হয়ে যাবে ।ধনবাদী সমাজ টিকবে না ।বরং এ দুয়ের নিরাকরণের মধ্য দিয়ে নতুন এক শ্রেণীহীন সমাজের আবির্ভাব ঘটবে।
কুমুর সাথে মধুসূদনের বিবাহের পর প্রায় সময়ই মধুসূদন চেষ্টা করেছে কুমুর ওপর আধিপত্য বিস্তার করার ।মধুসূদন ধনবাদী সমাজের প্রতিভূ হিসেবে সব সময় চেয়েছে ক্ষয়িষ্ণু জমিদার বিপ্রদাসের ওপরে প্রভুত্ব বিস্তার করার।
শারীরিক চাহিদার প্রয়োজনে মধুসূদন কুমুদিনীকে কাছে পেতে চাই কিন্তু যখনই সে দেখে বিপ্রদাসের চিঠি বা টেলিগ্রাম অথবা বিপ্রদাসের কারণে কুমুর মন খারাপ করে আছে। মধুর ডাকে কুমু কোন সাড়া দিচ্ছে না, তখনই মধুসূদন কটাক্ষ করে কথা বলে ।
মূলত মধুসূদন কটাক্ষ কুমুকে করে না, করে বিপ্রদাসকে ।প্রকৃতপক্ষে ক্ষয়িষ্ণু সামন্ত সমাজ ও ধনবাদী জমিদারদের দ্বন্দ্ব চিত্র টি তুলে ধরার জন্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে কুমুদিনীর আগমন ঘটিয়েছেন।
তাই শুধুমাত্র কুমুর দাম্পত্য সম্পর্কই মূল বিষয় নয়; যোগাযোগ উপন্যাস সার্থক হয়ে উঠেছে ক্ষয়িষ্ণু জমিদার বিপ্রদাস এবং বণিক মহাজন’ মধুসূদনের সাংঘাতিক জীবন চিত্র অঙ্কনের সুচারু দক্ষতাতেও ।
যোগাযোগ উপন্যাস বই কিনতে এখানে ক্লিক করুন:
আমাদের ওয়েবসাইটে অন্য বিষয় পড়তে ক্লিক করুন