শকুন্তলা গ্রন্থে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের গদ্য নির্মিতি কৌশল/ভাষা পর্যালোচনা

শকুন্তলা গ্রন্থে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের গদ্য নির্মিতি কৌশলভাষা পর্যালোচনা

বাংলা গদ্যের জনক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কবি কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ নাটকটি ‘শকুন্তলা’ নামে অনুবাদ করে  মৌলিকতা প্রদর্শন করেছেন। কারণ মূল ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ নাটককে তিনি সূত্রধর ও নটী বর্জন করে সংলাপের সাবলীলতা রক্ষা করে, কথাসাহিত্যের ছন্দময় গদ্য ভাষায় উপস্থাপন করে উপন্যাসের রস এতে সঞ্চালন করেছেন।

বিদ্যাসাগরের শকুন্তলায় ব্যবহৃত ভাষাশৈলী অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ ঋজু, প্রাঞ্জল। বিদ্যাসাগর গদ্যশৈলীর মাধ্যমেও তাঁর অনুবাদে মৌলিকতা প্রদর্শন করেছেন । কালিদাসের মূল নাটকটির বিভিন্ন সংলাপকে তিনি ঋজু সাবলীল হৃদয়গ্রাহী ও স্বচ্ছন্দভাবে তাঁর গদ্য ভাষায় বিন্যাস করেছেন।

“বস্তুত: বাঙলায় এই উপখ্যানের সঙ্কলন করিয়া আমি কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলমের অবমাননা করিয়াছি। পাঠকবর্গ! বিনীত বচনে আমার প্রার্থনা এই যে, আপনারা যেন। এই  শকুন্তলা দেখিয়া কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলমের উৎকর্ষ পরীক্ষা না করেন।”

কিন্তু বিদ্যাসাগর অনূদিত ‘শকুন্তলার’ অ্যাখান পড়ে পাঠকবর্গ নিশ্চয়ই বুঝেছিলেন বিদ্যাসাগরের বিনয় মাত্র। তার অনুবাদে কালিদাসের অবমাননা হয়নি। অসাধারণ নিপুনতার সঙ্গে তিনি কালিদাসের নাটকের কাহিনীর বঙ্গানুবাদ করেছেন। বস্তুত, ‘শকুন্তলার দ্বারাই তিনি পাঠকমহলে যথার্থ সাহিত্যরস ও লিপিকৌশল শকুুন্তলায় প্রকাশিত

কালিদাসের ‘শকুন্তলা’ নাটক, কিন্তু বিদ্যাসাগরের অনুবাদকৃত ‘শকুন্তলা’ গদ্য। তিনি নাটকের সংলাপকে বিবৃতিতে রূপান্তরিত করেছেন। নাটকের আখ্যানভাগকে গদ্যে বিবৃত করে তিনি অগ্রসর হয়েছেন এবং সাত অঙ্কে বিভক্ত অভিজ্ঞান শকুন্তলম -এর ঘটনা সন্নিবেশকে সাতটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত করেছেন। সংলাপ এবং ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রবহমান নাটকীয় কাহিনী গদ্য বিবৃতির দ্বারা উপস্থাপিত করতে হলে বহু স্থলে স্বয়ং লেখককে প্রয়োজকের ভূমিকা নিতে হয়। নাটকে যে বা
কাহিনী শোভা পায়,অনেক সময় গদ্য কাহিনীতে তার যৌক্তিকতা থাকে না।

বিদ্যাসাগরের গদ্যের বিরুদ্ধে একটা সাধারণ অভিযোগ এই যে, তাঁর গদ্য তৎসম শব্দবহুল ও ভাব গুরুগম্ভীর।

এই অভিযোগের পরি- প্রেক্ষিতে বলা যেতে পারে। গদ্য রচনায় তাঁর আদর্শ ছিল সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য ৷ বিদ্যা- সাগরের ‘শকুন্তলা’ গদ্যেও আমরা সংস্কৃত- বহুল শব্দ পাই; যা থেকে বোঝা যায় বিদ্যা সাগরের সংস্কৃত ভাষায় অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিল। যেমন মহর্ষি কন্বের উক্তিতে একটি বাক্য-

“মহর্ষি মনে মনে কহিতে লাগিলেন, যেমন, স্থাপিত ধন ধনস্বামীর হস্তে প্রত্যর্পিত হইলে, লোক নিশ্চিন্ত ও নিরুদ্বেগ হয়;  অদ্য আমি শকুন্তলাকে পতিগৃহে প্রেরণ করিয়া নিশ্চিন্ত ও নিরুদ্বেগ হইলাম ।” (চতুর্থ পরিচ্ছেদ)

বাংলা সাধুভাষায় ব্যবহৃত শব্দ অধিকাংশই তদ্ভব বা সংস্কৃত শব্দ। সুতরাং, বিদ্যাসাগরের রচনায় সংস্কৃত শব্দের আধিক্য থাকবারই কথা। তাছাড় বিদ্যাসাগর  ক্রিয়াপদের স্থলে প্রায়ই তৎসম ভাববচন সংবলিত ক্রিয়াপদ ব্যবহার করেছেন। এজন্য অতটা গুরুগম্ভীর বলে রচনাকে  মনে হয়। যেমন: “গেলেন’ স্থলে গমন করিলেন; হরিয়াছে’ স্থলে ‘হরন করিয়াছে” ইত্যাদি। এমন যুক্ত ক্রিয়াপদের ব্যবহারে ভাষা কিছুটা গুরুগম্ভীর হলেও বাক্যের ঔজস্বিতা ও মাধুর্য রেড়েছে, তা অনস্বীকার্য। এই ওজস্বিতা বিদ্যাসাগরের গদ্যের একটি বড় বৈশিষ্ট্য।

ভরত যদি  দুষ্মন্তের পুত্র না হয় তবে ভরতের বাধ রাখি মাটিতে পতিত হলে তা সাপ হয়ে দুষ্মন্তের দংশন করবে। অলৌকিক বলে কালিদাস তা বর্জন করেছেন।

প্রবাদ প্রবচন এবং বগিধারার ব্যবহার
“পার্থনা করি, আপনার পুত্র এই সসাগরা সদীপা পৃথিবীর অদ্বিতীয় অধিপতি হউন। “

“বুঝিলাম, আজ উদানলতা, সৌদর্যগুণে, বনলতার নিকট পরাজিত হইল।”(১ম পরিচ্ছদ)

ইতিবাচক শব্দের ব্যবহারঃ

” প্রিয়ংবদা যথার্থ কহিয়াছে “
রুপকথা এবং বাৎসল্যরসের ব্যবহার আছে

বিদ্যাসাগর এই গ্রন্থের জন্য মূল সংস্কৃতের হুবুহু অনুবাদ ও বিষয় অনুযায়ী ভাষাকে সাজিয়েছেন। বিদ্যাসাগর উপন্যাস  রচনার পথ উন্মুক্ত করছেন।

আরো সাহিত্য পড়তে ক্লিক করুন এখানে

শকুন্তলা ইতিহাস- click here

1 thought on “শকুন্তলা গ্রন্থে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের গদ্য নির্মিতি কৌশল/ভাষা পর্যালোচনা”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *