সব্যসাচী চরিত্র । বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগের অন্যতম বাঙালি কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক রচিত একটি জনপ্রিয় উপন্যাস পথের দাবী।
ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে এক অসাধারণ বিপ্লবী সব্যসাচী ও তার সাথীদের সংগ্রামের কাহিনী নিয়ে বৃটিশ শাসনামলে লিখিত একটি রাজনৈতিক ও সাহসী উপন্যাস হলো পথের দাবী।
হাজার 1926 সালে প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে হাজার 1927 সালে ব্রিটিশ সরকার রাজনৈতিক কারণে এই উপন্যাসটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল
সব্যসাচীর পরিচয় পাওয়া যায় অপূর্ব ও নিমাইবাবুর কথোপকথনের মধ্য দিয়ে।
অপূর্ব এবং নিমাইবাবু জাহাজ ঘাটে যাচ্ছিলেন । যেতে যেতে তাদের আলোচনায় নিমাইবাবু জানালেন যে নিমাইবাবু চলেছেন একজন বিখ্যাত বিপ্লবীর সন্ধানে । নিমাইবাবু ঠাট্টা করে বিপ্লবী না বলে বললেন মহাপুরুষ। বললেন – মহাভারতের মতে নাকি তার দুটো হাতই সমান চলতো কিন্তু প্রবল প্রতাপ সরকার বাহাদুরের সুগপ্ত ইতিহাসের মতে এই মানুষটির দশ ইন্দ্রিয় নাকি বাবা সমান বেগে চলে ,বন্দুক পিস্তলে এর অভ্রান্ত লক্ষ। পদ্মা নদী সাঁতার কেটে পার হয়ে যান বাধে না।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সব্যসাচীকে মানুষ হিসেবে তৈরি করেননি । করেছেন বিপ্লবী হিসেবে ,একজন মহামানব এর আদলে ।যাকে ঠিক বাস্তবে খুঁজে পাওয়া যায় না। যিনি বিরাজ করেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা প্রত্যাশী শরৎচন্দ্রের মানসে।
সব্যসাচীর ইংরেজবিরোধীতা শুধু লোক দেখানো নয়, পরিষ্কার যুক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত তার চিন্তা। তিনি ভারতের দারিদ্র্যের অর্থনৈতিক কারণ গুলো খুঁজে বের করেন। তার আত্মমর্যাদা সম্পন্ন স্বাধীনচেতা দাদা ডাকাতের হাতে প্রাণ হারান মৃত্যুর আগে তিনি সব্যসাচী কে বলেছিলেন-
“রাজত্ব করার লোভে যারা সমস্ত দেশটার মধ্যে মানুষ বলতে আর একটি প্রাণী ও রাখেনি,
তাদের তুই জীবনে কখনো ক্ষমা করিস নে।”
ইংরেজরা ভারতের অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে দিয়েছে এবং তারা বাইরের শক্তি হয়েই রয়ে গেছে।
ইংরেজরা এদেশ থেকে সবকিছু লুটপাট করে নিয়ে গিয়ে তাদের নিজের দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি করেছে আর ভারতবর্ষকে করেছে পঙ্গু।
দেশীয় পুঁজি এবং শিল্পের বিকাশ রোধ করার জন্য তারা প্রবর্তন করেছে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত।কৃষকের নিকট থেকে কর আদায় করে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে দেশীয় জমিদার শ্রেণী। তারা নিজেদের স্বার্থে ইংরেজদের সহায়তা করেছে এ বিষয়ে সব্যসাচী বলেন-
“একদিন মুসলমানের হাতেও এদেশ গিয়েছিল কিন্তু সমস্ত মনুষ্যত্বের এত বড় পরম শত্রু জগতে আর নেই । স্বার্থের দায়ে ধীরে ধীরে মানুষকে অমানুষ করে তোলাই এদের মজ্জাগত সংস্কার।এই এদের ব্যবসা ,এই এদের মূলধন।”
সব্যসাচী মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন শাসন ও সংস্কার দ্বারা ভারতবর্ষের কোন উপকার হবে না।দেশের স্বাধীনতায় সব্যসাচীর একমাত্র কাঙ্খিত বস্তু স্বরাজের প্রহসন নয় ,শাসন সংস্কারের আত্মপ্রবঞ্চনা নয়-
তার নিজের ভাষায়-
“ভারতের স্বাধীনতায় আমার একমাত্র লক্ষ্য ,আমার একটিমাত্র সাধনা। এই আমার ভাল ,এই আমার মন্দ, এ ছাড়া এ জীবনে আর আমার কোথাও কিছু নেই।”
বস্তুত সব্যসাচী তৎকালীন বিপ্লব পন্থীদের প্রতিনিধি। শরৎচন্দ্র স্বাধীনতা লাভের উপায় হিসেবে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করেছেন। সব্যসাচীর মধ্যেও আমরা এই বক্তব্যের প্রতিধ্বনি শুনি ।সব্যসাচী জানে পরাধীন ভারতবর্ষের কল্যাণ প্রচেষ্টা পন্ডশ্রম মাত্র ।তাই কল্যাণ তাঁর কাম্য নয়, সর্বপ্রথম কাম্য স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বিপ্লবকে বেছে নিয়েছেন সব্যসাচী।
তার ভাষায়-
দূর থেকে এসে যারা জন্মভূমি আমার অধিকার করেছে ,আমার মনুষ্যত্ব ,আমার মর্যাদা, আমার ক্ষুধার অন্ন, তৃষ্ণা’র জল সমস্ত কেড়ে নিলে, তারই রইল আমাতে মারার অধিকার ,আর রইল না আমার”
পথের দাবী উপন্যাসের সব্যসাচী চরিত্র
সব্যসাচী তার বিপ্লবী কর্মকান্ড পরিচালনা করে একটি গুপ্ত সমিতির মাধ্যমে ।পথের দাবী তার মধ্যে অন্যতম।
প্রথমত, গুপ্ত সমিতির মাধ্যমে বিপ্লবী কর্মকান্ড পরিচালনা ছাড়াও সব্যসাচী ও তার দল সেনাবাহিনীর সচেতনতা বৃদ্ধি এবং তাদের মধ্যে বিদ্রোহ ছড়ানোর চেষ্টা করেন।
দ্বিতীয়ত ,সব্যসাচী নির্বিচারে ইংরেজ রাজকর্মচারীদের হত্যা করাকে সমর্থন করতে পারে না ।তার মতে এ হলো বিপ্লবের ভ্রান্তপথ।
তৃতীয়ত, বিপ্লবীদের প্রতিমুহূর্তে নতুন নেতা ও কর্মী গড়ে তোলার শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়।কারো জন্য কর্মকাণ্ড যেন পিছিয়ে না পরে ।তিনি বলেছেন-
”মানুষ তো যাবেই ,যত বড় হোক ,কারো অভাবকেই যেন না আমরা সর্বনাশ বনে ভাবি”
চতুর্থত,সব্যসাচীর বিপ্লবে কারা অংশগ্রহণ করবে তাদের ওপর তার আস্থা তার বক্তব্য সুস্পষ্ট।
ক)মধ্যশ্রেণী:সব্যসাচী বিপ্লবের ক্ষেত্রে মধ্যশ্রেণীর উপর অধিক আস্থাশীল তার মতে, মধ্যবিত্তের সন্তানই পারে সবকিছু ত্যাগ করে স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে।সব্যসাচীর কারবার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ভদ্র সন্তানদের নিয়ে
পরাধীন দেশে অন্য সকলের চেয়ে মধ্যবিত্ত গৃহস্থের দুর্দশা শরৎচন্দ্রের অন্তরে বেশি বাজে। তার মতে এই শিক্ষিত ভদ্র জাতির চেয়ে লাঞ্ছিত অপমানিত ও দুর্দশাগ্রস্ত সমাজ বাংলাদেশ আর নেই।
সমাজ নারীত্বের সনাতন ধারণায় বিশ্বাসী নয় সব্যসাচীর বিপ্লব ও তার বিপ্লবী দলের সদস্যরা।
শরৎচন্দ্রের বিশ্বাস নারী সমাজের সকল প্রকার মুক্তি যতদিন নিশ্চিত না হবে, যতদিন তারা বাইরে এসে মাথা উঁচু করে পুরুষের পাশে দাঁড়াতে না পারবে, ততদিন স্বাধীনতা আসবেনা।
সব্যসাচীর বিপ্লবে নারীকর্মীর প্রয়োজন অনেক বেশি ।ভারতের প্রতি তার উক্তি-
”আগুন যদি কখনো এদেশে জ্বলেছে দেখতে পাও,যেখানেই থাকো ভারতী ,এই কথাটা আমার তখন স্মরণ করো ,এ আগুন মেয়েরাই জ্বেলেছে।
গ) কৃষক শ্রেণী: সব্যসাচী তার বিপ্লবে কৃষকদের অংশগ্রহণ বা সহযোগিতা আশা করে না।সব্যসাচীর একথা শুনে কৃষক বিরোধী মনে হলেও আসলে তা না। সব্যসাচী অপূর্বকে বলেছিল-
“এদের (কৃষকদের) দুঃখ দৈন্যের মূলে শিক্ষিত ভদ্র জাতি নয় ,সে মুল বার করতে হলে তোমাকে আর একদিকে খুড়ে দেখতে হবে।”
ঘ )শ্রমিক শ্রেণী: সব্যসাচীর বিপ্লবের সবচেয়ে বড় ধারালো অস্ত্র শ্রমিক শ্রেণী ।
পথের দাবী উপন্যাসের সব্যসাচী চরিত্র
সব্যসাচী যে স্বাধীনতার কথা বলেছে সে স্বাধীনতায় তার কাছে শেষ কথা নয়।তার চাইতেও অনেক বড় দেশের সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক বিকাশ। সংস্কৃতির সুষ্ঠু বিকাশের জন্য যেমন স্বাধীনতার প্রয়োজন তেমনি স্বাধীনতার সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করার জন্য সাংস্কৃতিক বিকাশ এর প্রয়োজন ।এজন্যই শশীর প্রতি তার এত শ্রদ্ধা। তার মতে শশী হবে বাংলার জাতীয় কবি, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান কোন সম্প্রদায়ের নয়।
কবি শশী রচনা করবে সামাজিক জাগরণ ,সামাজিক বিপ্লবের গান –
” কবি তুমি প্রাণ খুলে শুধু সামাজিক বিপ্লবের গান শুরু করে দাও ,যা-কিছু সনাতন ,যা কিছু প্রাচীন, জীর্ণ পুরাতন ধর্ম ,সমাজ- সংস্কার, সমস্ত ভেঙেচুরে ধ্বংস হয়ে যাক- আর কিছু না পারো শশী, কেবল এই মহা সত্যই মুক্তকণ্ঠে প্রচার করে দাও -এরচেয়ে ভারতের বড় শত্রু আর নেই।”
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সব্যসাচীর মানসে সৃষ্টি করেছেন ভারতের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীদের ।যেই সব্যসাচী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কথা বলেছে ,ভারত স্বাধীনতার কথা বলেছে ।
সব্যসাচী চরিত্র এবং অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে আরো জানতে ক্লিক করুন এখানে-
সব্যসাচী চরিত্র সম্পর্কে অন্য ওয়েবসাইটে আরো জানতে ক্লিক করুন এখানে-
Real Estate Great information shared.. really enjoyed reading this post thank you author for sharing this post .. appreciated